Godaddy coupon

Godaddy coupon
www.couponhosters.com/coupons/godaddy-coupon/

Exclusive 93% OFF GoDaddy coupon� www.couponhosters.com GoDaddy coupon (promo code) gets you a new dot-com domain for just 99 cents. Did the peeps who make everything that GoDaddy Coupon magic simply lose their little personalities? They should have, to offer another domain or exchange for 99 pennies (extra .COMs just $9.99 per year*) GoDaddy coupon can save your valuable money. GoDaddy offers coupons for each need of yours. Because of them, you can save much more. What抯 your name? Let抯 assume it so anyone can hear. Presently, say it so anyone can hear and include 揹ot-com� to the end. What? You don抰 have your-name-dot-com sealed up? Get it, with the codes underneath. Oh, you do have that sealed up? Shouldn抰 something be said about the new Top-Level Domains (TLDs) that ICANN is discharging? Try not to let participants (or different peeps with your same name) snatch that extremely valuable real estate, use the codes beneath and ensure your band.
The GoDaddy coupon (promo code) gets you 30% off your whole request for new products only.* So on the off chance that you require all the great stuff that GoDaddy brings to them offer, you can stack up that cart and save huge on everything at the same time. Are you hunting down for GoDaddy Promo Code For your hosting and domain to renew�? We抣l give you some selective GoDaddy Renewal Coupon Codes To deduct some expense of Domain, hosting, SSL and renewals. Using this limited GoDaddy renewal coupon, you can collect 27% OFF on GoDaddy Domain Renewal. So, check this link
www.couponhosters.com

মুসলিম নির্যাতন চিত্র

<!DOCTYPE html>
<html>
<head>
<title>ভিডিও</title>
</head>
<body>
<video width="320" height="240" controls>
<source src="https://youtu.be/1MifxI1_7FU" type="video/mp4">
Your browser does not support HTML5 video.
</video>
</body>
</html>

গর্ভবতী মায়ের ত্বকের যত্ন

এটা খাও, ওটা খাও—অনাগত সন্তানের কথা ভেবে গর্ভবতী মাকে এমন কথা প্রায়ই শুনতে হয়। আর তাই ঘুরে-ফিরে অভিভাবকেরা গর্ভবতী মায়ের হাতে তুলে দিচ্ছেন কখনো দুধের গ্লাস, কখনো বা ফল। কিন্তু গর্ভবতী মায়ের ত্বকের যত্ন যেন সবাই ভুলেই যান। অনেকেই হয়তো ভাবেন, গর্ভবতী মায়ের আবার ত্বকের যত্ন কেন?। এ সময় খাওয়া-দাওয়াটাই তো মুখ্য। তবে একটু লক্ষ করলেই দেখা যায় যে গর্ভকালীন মায়েদের ত্বকে দেখা দেয় মেছতা, ব্রণ বা কালো ছোপ ছোপ দাগ। আবার কখনো বা ত্বক ফেটে যায়। এ সময়ে ত্বকের সঠিক পরিচর্যা না করলে অনেক সময় তা স্থায়ী হয়ে যায়। এমনটাই বললেন রূপবিশেষজ্ঞ রাহিমা সুলতানা। তিনি বলেন, মায়ের হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মূলত ত্বকে নানা ধরনের সমস্যা হয়। এ কারণে গর্ভকালীন মায়ের ত্বকের যত্নের জন্য কিছু টিপস দিয়েছেন তিনি।
তাঁর মতে, এ সময়ে নিয়ম করে সপ্তাহে অন্তত একদিন হালকা গরম পানি দিয়ে সারা শরীর পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। কেননা, শরীর তখন অপেক্ষাকৃত ভারী হয়ে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন ভাঁজে ময়লা জমতে পারে। তাই হালকা ম্যাসাজ করে পরিষ্কার করা ভালো। মুখের ত্বকের ধরন বুঝে সপ্তাহে একবার ঘরে তৈরি করা প্যাক ব্যবহার করার পরামর্শ দেন তিনি। শুষ্ক ত্বকের জন্য কাঠবাদাম পেস্ট, সয়াবিন পাউডার, গাজরের রস মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে ত্বক হবে মসৃণ। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মুখ পরিষ্কার করে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা ভালো।
তৈলাক্ত ত্বকের জন্য সিকি চামচ মধু, শসা, গাজরের রস, মেথি গুঁড়া দিয়ে প্যাক তৈরি করে ব্যবহার করা ভালো। যেকোনো রকম ত্বকে মধু ব্যবহার করা যাবে, কারণ মধু ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। স্বাভাবিক ত্বকের জন্য কাঁচা হলুদ, মধু, মুলতানি মাটি, মসুর ডাল দিয়ে বেটে প্যাক তৈরি করে ব্যবহার করলে কাজে দেয়। আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে অবশ্যই কাপড় পরিবর্তন করে ঢিলেঢালা পাতলা কাপড় পরে ফেলুন। এতে ঘুম ভালো হয়। আর ভালো ঘুম হলে শরীর এবং ত্বক দুটোই ভালো থাকবে। অনেক সময় ত্বকে কালো বা বাদামি রঙের মেছতা দেখা যায়। অবহেলা করলে এই মেছতার দাগ স্থায়ীভাবে বসে যেতে পারে। মেছতার দাগ তোলার জন্য তেঁতুলের রস ও মধু দিয়ে ম্যাসেজ করে ডিমের সাদা অংশ, ডাবের পানি, কাঁচা হলুদ দিয়ে প্যাক তৈরি করে ব্যবহার করতে পারেন। ব্রণের সমস্যা হলে ব্রণ যেখানে উঠেছে সেখানে লবঙ্গ গুঁড়া পেস্ট করে লাগালে ব্রণ কমে যায়।
গর্ভকালীন অনেকের চুল পড়ার সমস্যা দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, টকদই, ডিম, কাঁচা মেহেদি দিয়ে চুলের প্যাক তৈরি করে ১০ দিন অন্তর ব্যবহার করলে চুল ঝরঝরে থাকবে, চুল পড়া কমে যাবে। আর চুলে নিয়মিত তেল দিতে হবে। তবে রাতে তেল দিয়ে সকালে শ্যাম্পু করলে ভালো।

নিশিডাক!

রুমী !
কেযেন ফিসফিস করে ডাকলো কানের কাছে মুখ এনে ।কি গভীর প্রেমের ডাক !! আলতো করে ঘাড়ে একটা চুমু এঁকে দিল । চমকে ঘুম ভাঙ্গলো রুমীর । শোয়ার আগে ঘরের সব বাতি বন্ধ করেই শুয়েছিল । তখন ঘর ছিল অন্ধকার । কিন্তু এখন ঘরটা যেন ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায় !! মস্ত এক চাঁদ রুপালী আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে মিটিমিটি হাসছে যেন ওর দিকেই চেয়ে ।অভিভূত রুমী জানালার দিকে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে ।

কিন্তু ডাকটা !! কে ডাকলো ওকে অমন করে ? ঘাড়ের পাশে আঁকা আদরের স্পর্শটা যেন এখনো অনুভব করা যাচ্ছে ।

রুমী । ওই আবার !! চমকে এদিক ওদিক তাকালো ।নাহ্ কেউ তো নেই ঘরে !! জানালার ফাঁক দিয়ে তাকালো নিচের দিকে ।ওই তো , ওখানে কাকে দেখা যায় ? হঠাৎ ঘুরে চাইলো ।ওর চোখে চোখ পড়তেই মুচকি একটু হাসলো ।হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো ।

ঘোর ঘোর , কি এক আশ্চর্য ঘোরে পেয়েছে রুমিকে !! পরনে যে শুধু পাতলা রাতের পোষাক সেই হুঁশও নেই ওর । দরজাটা খুলে বের হয়ে এল ।ওইতো সে, ডাকছে ওকে !! পিছু পিছু হেঁটে যাচ্ছে রুমী , কোথায় সে জানে না । জানতে চায়ও না ।শুধু যেতে হবে এটুকুই জানে ।

হাঁটছে তো হাঁটছেই । জলা জঙ্গল পাথর কিছুই মানছে না ।কাঁটা গাছে লেগে ছিড়ে যাচ্ছে পরনের পোষাক । পাথরে চোট খেয়ে রক্ত ঝরছে পা থেকে ।তবু হুঁশ নেই ।যেতেই হবে ওকে ।

ওই তো আবার ঘুরে তাকালো ওর দিকে , হাসলো মায়াভরা হাসি !! শুধু ওই হাসি আর মাত্র একবার দেখার জন্য বুঝিবা অনন্তকাল হাঁটা যায় !!

হঠাৎই থামলো , হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। সেই ডাকে সাড়া দেবে না সাধ্য কি রুমির !!পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই হাত ইশারায় দেখাল -” দেখো কি সুন্দর ” ।রুমী দেখলোএক অতলান্ত খাদের কিনারায় দাড়িয়ে ওরা । মাথার ওপর চাঁদের আলোর বন্যা কিন্তু তার স্পর্শ পায়নি খাদের বেশিরভাগ অংশ । তলায় শুধু নিরেট আঁধার !!

দুহাতে জড়িয়ে ধরলো সে ।কানের কাছে মুখ রেখে বল্ল -“ওখানে , ওই অন্ধকারে লুকিয়ে আছে সুখ । যেতে চাও ওখানে ? আমার সাথে ? “বিবশ রুমী শুধু মাথাই নাড়তে পারলো – চায় ।নিজের দিকে ঘুড়ালো রুমীকে । ঠোঁটে চুমু খেল গভীরভাবে ।”চলো ” বলে ওর হাত ধরে টান দিলো।

তারপর কি সুন্দর পাখির মত ভেসে ভেসে নেমে চল্ল ওরা দুজনে !! কোথায় কতদুরে জানা নেই ।কি সুখ !! কি সুখ !!

পরেরদিন অনেক খোঁজাখুঁজির পর রুমীর মরদেহ পাওয়া গেল খাদের তলায় । অত উপর থেকে পরে মাথার পেছনটা থেঁতলে গেছে একেবারে ।শরীরের হাড়গোড়ও সব ভাঙ্গা । কিন্তু কি আশ্চর্য , ওর মুখে গভীর তৃপ্তির হাসি !!

আমি এবং মামা

ঘটনাটি ৩-৪ বছর আগে আমার মামার সাথে ঘটছিলো।ঘটনাটি মামার ভাষাতেই

দিলাম।তখন রাত ১টা বাজে।দোকান বন্ধ করব।হঠাত্ মোবাইলে একটা কল

এল।দেখি বন্ধু শাহীন ফোন করেছে। ভাবলাম,এত রাতে ওর ফোন ,কাহিনী কি?ফোন ধরলাম।ধরেই

একটা দুঃসংবাদ শুনতে হল।ওর চাচা কিছুক্ষন আগে মারা গেছেন।কাল

সকালে তার জানাজা হবে।এখন মসজিদে মসজিদে গিয়ে হুজুরদের

বলতে হবে তারা যেন ফজরের ওয়াক্তে মাইকিং করে দেন।আমি ওর

সাথে যেতে পারব কিনা জানতে চাইল। আমি এককথায় রাজি হলাম।আধ ঘণ্টার

মধ্যে ওর বাসায় হাজির হলাম।তারপর দুজনে একসাথে বের হয়ে বিভিন্ন

মসজিদে যেতে লাগলাম।তখন ৩টা কি ৩’৩০টা বাজে।দুজনে এক

মসজিদ থেকে বের হয়ে আরেকটি মসজিদের

দিকে রওনা হলাম। যে মসজিদটিতে যাচ্ছিলাম

তাতে যেতে হলে মাঝখানে একটি ডোমপাড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

দুজনে ডোমপাড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।বন্ধুর মন খারাপ

তাই সে কোন কথা বলছিল না।পাড়াটি অত্যন্ত নোংরা।রাস্তার

পাশে কিছুদূর পরপর স্ট্রিট লাইটপোস্ট। কিছুদূর এগোনের পর অদ্ভূত

অনুভূতি হতে লাগল,মনে হল কে যেন আড়াল থেকে আমাদের দেখছে।

শাহীনেরও যে একই অবস্থা হয়েছিল তা পরে জেনেছি।অস্বস্তি কাটাবার

জন্য দুজনে কথা বলতে বলতে এগোতে লাগলাম।

যেতে যেতে রাস্তার একটা মোড় ঘুরবার পর দেখি সামনে ১০-১২বছরের টাক

মাথার একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা একটু অবাক হলাম।এত রাতে এত

ছোট একটা ছেলে বাহিরে কি করছে? আমরা এগিয়ে গেলাম।পিচ্চিটাকে বললাম

এই তোর বাড়ি কই?এত রাতে এখানে কি করস?পিচ্চিটা কিছু

না বলে মাথা নিচু করে হাঁটা ধরল। এরপর

সে যা করল তা এককথায় অবিশ্বাস্য। সে রাস্তার পাশের ড্রেনের দিকে এগিয়ে গেল

এবং আস্তে আস্তে ড্রেনের মধ্যে পুরোপুরি ঢুকে গেল!!! আমরা সাথে সাথে দৌঁড়ে ড্রেনের

কাছে গিয়ে উকি দিলাম।কিন্তু পিচ্চিটার

ছায়াও দেখলাম না।এত তাড়াতাড়ি চম্পট দেয়া কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না।

তার চেয়েও বড় কথা হল ড্রেনটা এত

সরু যে কোন ১০-১২বছরের ছেলে সেটায় পুরোপুরি ঢুকতে পারবে না।

রাস্তার পাশের স্ট্রীট লাইটের আলোয় ঘটনাটা চাক্ষুষ করলাম।কেমন যেন ধোকা লাগল।যাই

হোক,ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে চলতে লাগলাম। অদ্ভূত অনুভূতিটাও বহাল রইল।আরেকটু

এগোনের পর কি কারনে যেন একটা লাইটপোস্টের মাথার দিকে নজর

গেল।যা দেখলাম তাতে দম বন্ধ

হয়ে গেল।পোস্টের মাথায় ঝুলছে একটা লাশ,পিচ্চিটার লাশ!!!

এইবার বুঝতে পারলাম কিসের পাল্লায়

পড়েছি।শাহীনও লাশটা যে লক্ষ্য করেছে তাও বুঝলাম তার পরের কথায়।

সে শুধু বলল দোস্ত ,ভাগ।দুজনে দৌঁড় লাগালাম।কতদূর দৌড়াবার পর

থামলাম।

মনে হল বেঁচে গেছি।কিন্তু হঠাত্ করে শাহীনের চিত্কার।ওর

দিকে ঘুরে দেখি সে উপরের দিকে আঙুল

তাক করে আছে।উপরের দিকে তাকাতেই

দেহে কাঁপুনি ধরে গেল।সেই পোস্ট,সেই লাশ!!!চারপাশের পরিবেশও

চেনা মনে হল।একটু আগেই এখান থেকে পালিয়েছিলাম।মাট িতে ধুপ করে কিছু পড়ার শব্দ শুনে ঘুরে দেখি শাহীন মাটিতে পড়ে আছে।

হঠাত্ করে বিদঘুটে হাসির শব্দ শুনে পোস্টের

দিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তা আমার কল্পনাতীত।পোস্ট ের মাথায়

কোন লাশ নেই!!!ঐটার নিচে দাঁড়িয়ে অট্টহাসি হাসছে পিচ্চিটা!!! হঠাত্ করে সে হ্যাঁচকা টান

দিয়ে নিজের মাথা ছিঁড়ে ফেলল!!!আলোতে স্পষ্ট দেখলাম চারপাশে রক্ত ছিটকে পড়ল।

কাটা মাথাটি পাগলের মত হাসতে লাগল।এরপর কাটা মাথা হাতে কবন্ধটি আমাদের

দিকে এগোতে লাগল।আমি আর সহ্য করতে পারলাম না।আল্লাহ আল্লাহ

করতে করতে চেতনা হারিয়ে ফেললাম। পরদিন যখন হুঁশ হয়

বুঝতে পারি আমরা একটা মসজিদে আছি। পরবর্তীতে জানতে পারি যে ফজরের

ওয়াক্তে মসজিদে আসার পথে আমাদের পড়ে থাকতে দেখে মুসল্লীরা আমাদের

মসজিদে নিয়ে এসেছে।এটা ছিল সেই মসজিদ যেটার

উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হয়েছিলাম। ইমাম সাহেবের কাছে আমরা সব

কথা বললে তিনি বলেন যে ঐটা ছিল খারাপ প্রকৃতির প্রেত যা মানুষের পথ

ভুলিয়ে দিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে ক্ষতি করে থাকে। তিনি আমাদের

রাতে বাইরে থাকতে নিষেধ করলেন।তার কথা আজও মেনে চলি।

গাধার বাচ্চা

সৈয়দ রহিম মিঞার মেজাজ ভীষণ খারাপ। তার একমাত্র ছেলে মন্টু মিঞা এইবার তৃতীয়বারের মত এস,এস,সি পরীক্ষা দিয়েছে। ফলাফল সম্ভবত একই। কারন আজ পরীক্ষার রেজল্ট হবার কথা। একারনেই হয়ত সকাল থেকেই মন্টুর কোন খোজ নেই। রহিম মিঞা মন্টুকে খুজে না পেয়ে যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। হতচ্ছাড়া, নালায়েক পোলা আবার ফেল করেছে। পোলাকে সামনে না পেয়ে রাগটা গিয়ে পড়ল স্ত্রীর উপর। কান ফাটানো শব্দে চেচিয়ে উঠলেন, “মন্টুর মা, ও মন্টুর মা. . . . গেলা কই। মরলা নাকি?” মন্টুর মা ই বা কম যায় কিসে? হাজার হোক, তিনি সৈয়দ বাড়ীর বউ। সমান তেজে জবাব দিলেন, “কি কইবা, কও। আমি শুনতাছি।“
- “তোমার নালায়েক পোলা কই পালাইছে?”
- “পোলা কি শুধু আমার? তুমি খোজ রাখবার পার না?
- “দেখ মন্টুর মা, তোমার লাই পায়া পায়া পোলা গোল্লায় গেছে। কই লুকায়া রাখছ কও? আইজ আমার সাধের লাঠি ওর পিঠে আমি ভাঙ্গুমই ভাঙ্গুম।“
- “কেন? আমার পোলায় কি করছে?”
- “কেন? তুমি বোঝ না? এত বেলা হইল পোলার কোন খবর নাই। আইজ পরীক্ষার রেজল্ট দিতাছে। গাধার বাচ্চা নিশ্চই ফেল করছে। না হইলে পলাইব কেন?”
- “তাইত কই! পোলা আমার পত্যেক বার ফেল করে কেন? গাধার বাচ্চা কোন সময় পাশ করবার পারে? গাধার বাচ্চাতো সারা জীবন গাধাই থাকে।“

রহিম মিঞা রাগের মাথায় ভুল করে মিসটেক করা বাক্যটার হাত থেকে রেহাই পেতে লাঠি হাতে ছেলের খোজে বের হয়ে গেল।

যথাসময়ে পরীক্ষার রেজল্ট পাবলিশ হল। রহিম মিঞার ধারণা সত্য প্রমাণ করার জন্যই মনে হয় অনেক খুজেও মন্টু তার রোল পাশকরা ছাত্রদের মধ্যে দেখতে পেল না। মনের মধ্যে দশ নম্বর বিপদ সংকেত শুনল। আর দেরী নয়, ঝেড়ে দৌড় লাগাল মন্টু মিঞা। পরবর্তী দৃশ্য বড়ই মনোরম। মন্টু মিঞা দৌড়াচ্ছে। পিছনে লাঠি হাতে রহিম মিঞা। সমান তালে চেচ্চাচ্ছেন তিনি। “ধর, ধর”।

মন্টু জান প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে মন্টুর বন্ধু হাবলু ভাবল মন্টু নিশ্চই বিপদে পড়েছে। নিশ্চই তারে পাগলা কুত্তা তাড়া করছে। না হইলে এই ভাবে দৌড় দিবে কেন? সে আপন মনে দৃশ্যটা কল্পনা করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। রহিম মিঞা হাবলুকে পাশ কাটনোর সময় তাকে এভাবে হাসতে দেখে অবাক হলেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হইছেরে হাবা? এমুন কইরা হাসতাছস কেন?” হাবলু হাসতে হাসতে জবাব দিল, “কুত্তার তাড়া খায়া মন্টু এমুন দৌড় দিছে! দেইখা হাসতাছি।“ রহিম মিঞা হুংকার ছেড়ে বললেন, “কি? আমি কুত্তা? এত বড় সাহস!” মুহুর্তের মধ্যে রহিম মিঞার লাঠির দু ঘা হাবলূর পিঠে পড়ল। আর হাবলু? কিছু বুঝতে না পেড়ে জান বাচাতে মন্টুর সঙ্গী হল।

এদিকে মন্টু দিক বিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে দৌড়াতে গিয়ে ধাক্কা খেল পাশের বাড়ির হালিমের সাথে। হালিম আর মন্টু ধাক্কা খেয়ে চিৎপটাং। হালিম লাফিয়ে উঠে মন্টুকে জড়িয়ে ধরেই চিৎকার শুরু করল, “চোর! চোর!. . . .” মন্টু হালিমের হাতের চিপায় পড়ে চিও চিও করে বলে, “আমি চোর না। আমি মন্টু।“ হালিম মন্টুকে না ছেড়েই বলে, “ তাইলে এইভাবে চোরের লাহান দৌড় দিছিস কেন?” মন্টু হালিমের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য বলল, “দেখতেছিস না আব্বারে একটু দৌড় শিখাইতেছি। এইবার ছাড় নারে ভাই, আমি পালাই।“ হালিমের তবুও সন্দেহ যায় না। বলল, “একটু খাড়া। চাচা আসুক। আসল ঘটনা জাইনা লই।“ মন্ট ভাবল, ‘আমি এইবার শেষ।“ কি করা যায়? এমন সময় হালিম দেখল গগন বিদারী চিৎকার করতে করতে হাবলূ ছুটে আসছে। পিছনে লাঠি হাতে রহিম চাচা। মুহুর্তের মধ্যে মন্টুর হাত ছেড়ে সেও দৌড় দিল। পিছনে পড়ে রইল তার বিদায়ী বানী, ”চাচায় ক্ষেপছে।“ ছাড়া পেয়ে মন্টুইবা দেরী করবে কেন? সেও হাওয়া হল।

রহিম মিঞা বুড়া মানূষ। বেশিক্ষণ মন্টুর পিছে তাড়া করতে পারল না। সে হাটতে হাটতে এগিয়ে চলল। এই ফাকে মন্টু দৌড়ে তাদের ব্যবধান আরও বাড়িয়ে নিল। এক পর্যায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত মন্টু একটা খরের গাদা দেখতে পেয়ে সেখানে আরাম করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মন্টু এস,এস,সি পরীক্ষা দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু কোনদিন বই খুলে দেখছে কিনা সন্দেহ আছে। তাই সে খরগোশ আর কচ্ছপের গল্পটাও হয়ত জানে না। রহিম মিঞা হাটতে হাটতে খরের গাদার সামনে এসে হাজির হল। দেখল মন্টু আরাম করে ঘুমাচ্ছে। দেখে তার মেজাজ আরো খারাপ হল। মনে মনে ভাবল, “আমি সারাদিন হেটে বেড়াচ্ছি। আর নবাবজাদা আরাম করে ঘুমাচ্ছে।“ দেরী না করে হাতের লাঠি দিয়ে খোচা দিলেন তিনি। খোচা খেয়ে মন্টুর ঘুম একটু পাতলা হল। ঘুম জড়ানো কন্ঠেই সে বলল, “কোন শালারে?” এইবার রহিম মিঞা দু ঘা লাগিয়ে দিয়ে বললেন, “শালা না, আমি তোর বাপ।“ দু ঘা খেয়ে মন্টুর ঘুম বাপ বাপ করে পালাল। সেই সাথে সেও বাপ বাপ করে বলল, “আব্বাগো, এই বারের মত মাফ কইরা দাও। আমি আর জীবনেও ফেল করমু না।“ রহিম মিঞা আরোও দু ঘা লাগিয়ে বললেন, “গতবারও এই কতাই কইছিলি।“ মন্টু এই বার কাদতে কাদতে বলল, “আর কোন দিন কমু না। আবার যদি ফেল কার তবে তুমি কওনের সুযোগ দিও না। কওনের আগেই. . . . .“ রহিম মিঞা উত্তেজিত হয়ে বলল, “কি? কি কইতে চাস? কওনের আগেই তোরে জানে মাইরা ফালামু?” মন্টু ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, “না। আমি কইতে চাইছিলাম, কওনের আগেই মাফ কইরা দিও।“ রহিম মিঞার লাঠির আরো দু ঘা পড়ল মন্টুর পিঠে। মন্টু এইবার বাবার পা ধরে বলল, “এইবরের মত মাফ কর বাজান। দোষী তো খালি আমি একা না।“ রহিম মিঞা অবাক হলেন। বললেন, “দোষী তুই একা না, মানে?” মন্টু এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “সব দোষ বুঝি আমার? স্যারগরে দোষ নাই। স্যাররা যদি আমারে পড়াইতো, আমি কি ফেল করতাম?” রহিম মিঞা ভেবে দেখল, “তাইত! স্যারেরা যদি ঠিকমত পড়াইতো, তবে কি আর তার ছেলে ফেল করত? এইবার স্যারগরে ধরতে হইব।“ ছেলের হাত ধরে সে চলল হাইস্কুলের দিকে। এদিকে স্কুলের অংক স্যার কুদরত আলী প্রাইভেট পড়ানোর জন্য হাতে ছাতা ঝুলিয়ে সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিল। স্যারকে দেখে রহিম মিঞা হাতের লাঠি উঠিয়ে ডাক দিল, “মাস্টার সাব, ও মাস্টার সাব।“ কুদরত স্যার ইতিমধ্যেই হাবলু আর হালিমের কাছে রহিম মিঞার ক্ষেপে ওঠার ঘটনা জেনে গেছে। লাঠি হাতে রহিম মিঞাকে ছুটে আসতে দেখে তার মনের মধ্যে কু ডাক ডেকে উঠল। তিনি আর দেরী করলেন না। উল্টা দিকে ঘুরে ঝেড়ে দৌড় লাগালেন। কিন্তু তার ভাগ্য হাবলু আর হালিমের মত ভাল হল না। অনভ্যস্ত শরীরে দৌড়াতে গিয়ে খেলেন আছাড়। আছাড় খেয়ে পায়ের জুতো কোথায় গেল কে জনে? ছাতাটাও গেল বাকা হয়ে। কোন মতে হাচরে পাচরে উঠে দাড়ালেন। ততক্ষণে রহিম মিঞা মন্টুকে নিয়ে পৌছে গেছেন। কুদরত স্যার পালানোর আর পথ পেলেন না। ছাতা সারা আর জুতো খোজায় মন দিলেন। রহিম মিঞা কাছে এসে জানতে চাইলেন, “ওকি মাস্টার সাব। ওভাবে দৌড় দিলেন কেন?” কুদরত স্যার নিজেকে সামলে নিয়ে বলরেন, “ও কিছু না। আমাদের গেম স্যার আমাকে সকালে আধাঘন্টা আর বিকালে আধাঘন্টা করে এক ঘন্টা দৌড়াতে বলেছেন। তাইলে নাকি আমার শরীর ভাল থাকবে।“ ত্যাদর মন্টু হেসে বলল, “কিন্তু স্যার, এখনওতো বিকাল হয় নাই। এখন দুপুর বলা চলে।“ “চুপ কর বেয়াদব।“ কুদরত স্যার ধমকে উঠলেন। “তুই জানিস না, আমি অংকের স্যার। আমি অংক কষে বের করলাম, গড়ে সকালে ২০ মিনিট, দুপুরে ২০ মিনিট আর বিকালে ২০ মিনিট দৌড়ালে আমার একঘন্টা দৌড়ানো হবে। তাই সেভাবে দৌড়াই।“ এরপর রহিম মিঞার হাতের লাঠি দেখিয়ে কুদরত স্যার জানতে চাইলেন, “ওটার কাজ কি? লাঠি নিয়ে ঘুড়ছেন কেন? রহিম মিঞা দাত কিরমির করে বললেন, “গাধা পিটামু।“ এইবার কুদরত স্যার রেগে গেলেন। বললেন, “দেখেন, বিনা কারনে লাঠি নিয়ে তাড়া করলেন। আবার গাধা বলে গালি দিচ্ছেন। ভাল হচ্ছে না কিন্তু।“ রহিম মিঞা অবাক হয়ে বললেন, “আমি আবার আপনারে তাড়া করলাম কখন? আর গাধাই বা বললাম কখন? আমিতো গাধা কইছি আমার পোলা মন্টুরে।“ কুদরত স্যার হাফ ছেড়ে বাচলেন। বললেন, “কেন, কেন? মন্টুকে গাধা বলছেন কেন? কি করেছে আমাদের মন্টু?” রহিম মিঞা বললেন, “কি করেছে মানে? কি করে নাই সেইটা কন?” কুদরত স্যার তারাতারি শুধরে নিয়ে বললেন, “কি করে নাই মন্টু?” রহিম মিঞা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “পাশ। পাশ করে নাই মন্টু।“ কুদরত স্যার হতাশ গলায় বলেন, “আবারও ফেল।“ মন্টু দাত বের করে হাসতে হাসতে স্যারের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল, “জ্বী স্যার, আপনাদের বদ দোয়া।“ কুদরত স্যার লাফিয়ে তিন হাত পিছনে সরে গিয়ে বললেন, “বদ দোয়া মানে?” মন্টু দাত বের করেই উত্তর দিল, “স্যার, পাশকরা ছাত্ররা আপনাদের পায়ে হাতদিয়ে সালাম করে বলে ‘আপনাদের দোয়ায় পাশ করছি’। তাই আমি কইলাম, আপনাদের বদ দোয়ায় ফেল করছি।“ কুদরত স্যার ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন। আর রহিম মিঞা দ্বিতীয় বারের মত মন্টুকে বললেন, “গাধার বাচ্চা।“

অতৃপ্ত কামনা-কাজী নজরুল ইসলাম

   

সাঁঝের আঁধারে পথ চলতে চলতে আমার মনে হল, এই দিনশেষে যে হতভাগার ঘরে একটি প্রিয় তরুণ মুখ তার ‘কালো চোখের করুণ কামনা’ নিয়ে সন্ধ্যাদীপটি জ্বেলে পথের পানে চেয়ে থাকে না, তার মতো অভিশপ্ত বিড়ম্বিত জীবন আর নেই!

আমারই বেদনা-রাগে রঞ্জিত হয়ে গগনের পশ্চিম দুয়ারে জ্বালা সন্ধ্যা-তারা আমার মুখে তার অশ্রু-ভরা ছল-ছল চোখ নিয়ে চেয়ে ওই কথাটিতে সায় দিলে। ঝিল্লি-তান-মুখরিত মাঠের মৌন পথ বেয়ে যেতে যেতে শ্রান্ত চিন্তা কয়ে গেল, – ‘তোমায় ব্যথা বোঝে শুধু ওই এক সাঁঝের তারা!’

যদি কোনো ব্যথাতুর একটি পল্লি হতে আর একটি পল্লিতে যেতে এমনই সাঁঝে একা শূন্য মাঠের সরু রাস্তা ধরে চলতে থাকে – তার সামনে এক টুকরো টাটকা কাটা-কলজের মতো এই সন্ধ্যাতারাটি ফুটে ওঠে, তবে সেই বুঝবে কত বুক-ফাটা ব্যথা সে সময় তার মনে হয়ে তাকে নিপীড়িত করতে থাকে।

এই মলিন মাঠের শূন্য বুকে কিছু শোনা যাচ্ছে না, শুধু কোথায় সান্ধ্য নীড়ে বসে একটি ‘ধূলো-ফুরফুরি’ শিস দিয়ে দিয়ে বাউল গান গাইছে, আর তারই সূক্ষ্ম রেশ রেশমি সুতোর মতো উড়ে এসে আমার আনমনা-মনে ছোঁয়া দিচ্ছে! একটি দুটি করে আশমানের আঙিনায় তারা এসে জুটছে, আমার মনের মাঝেও তাই অনেক দিনের অনেক সুপ্ত কথার, অনেক লুপ্ত স্মৃতির একটির পর একটির উদয় হচ্ছে।….

আমার এই একই কথা, একই ব্যথা যে কত দিক দিয়ে কত রকমে মনে পড়ছে, তার আর সংখ্যা নেই। তবু বারে বারে ও-কথাটি ও-ব্যথাটি জাগবেই! মন আমার এ বেদনার নিবিড় মাধুর্যকে আর এড়িয়ে যেতে পারলে না। সাপ যেমন মানিক ছেড়ে তার সেই মানিকটুকুর আলোর বাইরে যেতে পারে না, আমারও হয়েছে তাই। আমার এই বুকের মানিক বেদনাটুকুর অহেতুক অভিমানের মায়া এড়িয়ে যেতে পারলাম না!

অনেক দূরে হাটের ফেরতা কোনো ব্যথিতা পল্লি-বধূ মেঠো সুরে মাঠের বিজন পথে গেয়ে যাচ্ছিল, –

‘পরের জন্যে কাঁদ রে আমার মন,
হায়, পর কি কখন হয় আপন?’

আমি মনে মনে বললাম – হয় রে অভাগি, আপন হয়; তবে অনেকে সেটা বুঝতে পারে না। বুকের ধনকে ছেড়ে গেলেই লোকে ভুল বুঝে বলে, –

‘পর কি কখন হয় আপন?’

আর একজনও ঠিক এমনই ভুল করে আমায় ছেড়ে গেছে, সে বেদনা ভুলবার নয়!

পথের বিরহিণীর ওই প্রাণের গান আমায় মনে করিয়ে দিলে অমনি আর একজন অভিমানিনীর কথা। সেই দিল-মাতানো স্মৃতিটি মাঝিহারা ডিঙির মতো আমার হিয়ার যমুনায় বারে বারে ভেসে উঠছে!

তাতে-আমাতে পরিচয় তো শুধু ছেলেবেলা থেকে নয় – তারও অনেক আগে থেকে; সেই চির-পরিচয়ের দিন তারও মনে নেই, আমারও মনে নেই। …

আমাদের পাড়াতেই তার বাড়ি।

তাকে আমার বিশেষ করে দরকার হত সেই সময়, যখন কাউকে, মারবার জন্যে আমার হাত দুটো ভয়ানক নিশ-পিশ করে উঠত। এ-মারারও আবার বিশেষত্ব ছিল; যখন মারবার কারণ থাকত, তখন তাকে মারতাম না, কিন্তু বিনা কারণে মারাটাই ছিল আমার খেপা-খেয়াল। আমার এ-পিটুনি খাওয়াটাকে সে পছন্দ করত কি না জানি নে, তবে দু-দিন না মারলে সে আমার কাছে এসে হেসে বলত, – ‘কই ভাই, এ দু-দিন যে আমায় মারনি?’

আমি কষ্ট পেয়ে বলতাম, – ‘না রে মোতি, তোকে আর মারব না!’ তার পর, সে সময় আমার হাতের সামনে যা-কিছু ভালো জিনিস থাকত, তাই তাকে দিয়ে যেন আমার প্রাণে গভীর তৃপ্তি আসত! মনে হত, এই নিয়ে সে হয়তো আমার আঘাতটাকে ভুলবে।

বই থেকে ছবি ছিঁড়ে তাকে দেওয়াই ছিল আমার সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। এর জন্যে প্রায়ই পাঠশালায় সারা দিন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। কিন্তু যখন দেখতাম যে, আমার দেওয়া ওই মহা উপহার সে পরম আগ্রহে আঁচলের আড়াল করে নিয়ে গিয়ে তার পুতুলের বিছানা পেতে দিয়েচে, কিংবা তার খেলাঘরের দেওয়ালে ভাত দিয়ে সেগুলো এঁটে দিয়েছে, তখন আমার পাঠশালার সব অপমান ভুলে যেতাম। কিন্তু তার ওই মেনি বিড়ালটাকে আমি দু-চোখে দেখতে পারতাম না, তাকে যে অত আদর করবে রাতদিন, এ যেন আমার সইত না। সে আমায় রাগিয়ে তুলবার জন্যে কোনো দিন আমার দেওয়া সবচেয়ে ভালো ছবিটা আঠা দিয়ে ওই মেনি বিড়ালছানাটার পিঠে এঁটে দিত, আমিও তখন থাপ্পড়ের চোটে তার দুলালি বিড়ালবাচ্চাটাকে ত্রিভুবন দেখিয়ে দিতাম।

তার দেখাদেখি আমিও সময় বুঝে যেদিন সে রেগে থাকত বা মুখখানা হাঁড়ি-পানা করে বসে থাকত, তখন জোর ধুমসুনি দিয়ে তাকে কাঁদিয়ে ছাড়তাম। তখন আমার আনন্দ দেখে কে! সে যত কাঁদত, আমি তত মুখ ভেঙিয়ে তাকে কাঁদিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতাম। এক এক দিন তার পিঠের চামড়ার পাঁচটি আঙুলের কালো দাগ ফুটিয়ে তবে ছাড়তাম! আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, ওই মার খাওয়ার পরেই সে বেশ শায়েস্তা হয়ে গেছে; আর, এক মিনিটে কেমন করে সব ভুলে গিয়ে জল ভরা চোখে মুখে প্রাণভরা হাসি এনে আমার আঙুলগুলো টেনে মুচড়িয়ে ফুটিয়ে দিতে দিতে বলছে, – ‘তোমার এই মারহাট্টা হাতের দুষ্টু আঙুলগুলোকে একেবারে ভেঙে নুলো করে দিতে হয়! তা হলে দেখি, তোমার ওই ঠুঁটো হাত দিয়ে কেমন করে আমায় মার!’ তার হাসি দেখে রেগে পিঠের উপর মস্ত একটা লাথি মেরে বলতাম, – ‘তাহলে এমনি করে তোর পিঠে ভাদুরে তাল ফেলাই!’

সে কাঁদতে কাঁদতে তার দাদাজিকে বলে দিত গিয়ে এবং তিনি যখন চেলা-কাঠ নিয়ে আমায় জোর তাড়া করতেন, তখন সে হেসে একেবারে লুটিয়ে পড়ত! রাগে তখন শরীর গশ-গশ করত। তাই আবার ফাঁকে পেলেই তাকে পিটিয়ে দোরস্ত করে দিতাম। কোনোদিন বা তার খেলা-ঘরের সব ভেঙে চুরে একাকার করে দিতাম, এই দিন সে সত্যি-সত্যি খেপে গিয়ে আমার পিঠে হয়তো মস্ত একটা লাঠির ঘা বসিয়ে দিন পনেরো ধরে লুকিয়ে থাকত, ভয়ে আর কিছুতেই আমার সামনে আসত না। সেই সময়টা আমার বড্ড দুঃখ হত। আ মলো, ও-লাঠির বাড়িতে আমার এ মোষ-চামড়ার কি কিছু হয়? আর লাগলই বা! তাই বলে কি বাঁদরি এমন করে লুকিয়ে থাকবে? তার পর যখন নানান রকমের দিব্যি করে কসম খেয়ে ফুসলিয়ে তাকে ডেকে আনতাম, তখন সে আমার লম্বা চুলগুলো নিয়ে নানান রকমের বাঁকা-সোজা সিঁথি কেটে দিতে দিতে বলত ‘দেখো ভাই, আর আমি কখ্‌খনো তোমায় মারব না! যদি মারি তো আমার হাতে যেন কুঠ হয়, পোকা হয়!’

তারপরে হঠাৎ বলে উঠত, –‘আচ্ছা ভাই, তুমি যদি আমার মতোন বেটি ছেলে হতে, তাহলে বেশ হত, – নয়? – দাও না ভাই, তোমার চুলগুলো আমার ফিতে দিয়ে বেঁধে দিই।’ কোনোদিন সে সত্যি-সত্যিই কখনো কথা কইতে কইতে দুষ্টুমি করে চুলে এমন বিউনি গেঁথে দিত যে, তা ছাড়াতে আমার একটি ঘন্টা সময় লাগত।…

তার পর কী হল? …

এই শূন্য মাঠের খানিকটা রাস্তা পেরিয়েই আমার মনের শাশ্বত শ্রোতা জিজ্ঞেস করে উঠল, – হাঁ ভাই, তার পর কী হল?

আমার হিয়ার কথক কিছুক্ষণ এই নিঝুম সাঁঝের জমাট নিস্তব্ধতার মাঝে যেন তার কথা হারিয়ে ফেললে! হঠাৎ এই নীরবতাকে ব্যথিয়ে সে কয়ে উঠল, – ‘না – তোমায় আমি ভালোবাসি! সেদিন মিথ্যা কয়েছিলাম মোতি, মিথ্যা কয়েছিলাম!’ তার এই খাপছাড়া আক্ষেপ সাঁঝের বেলায় তোড়ি রাগিণী আলাপের মতো যেন বিষম বে-সুরো বাজল! – সে আবার স্থির হয়ে তার সুর-বাহারে পুরবির মূর্ছনা ফোটালে! চির-পিয়াসি আমার চিরন্তন তৃষিত আত্মা প্রাণ ভরে সে সুর-সুধা পান করতে লাগল!

এমনি করেই আমাদের দিন যাচ্ছিল। সে যখন এগারোর কাছাকাছি, তখন তাকে জোর করে অন্দর-মহলের আঁধার কোণে ঠেসে দেওয়া হল। সে কী ছটফটানি তখন তার আর আমার! মনে হল, এই বুঝি আমার জীবন-স্রোতের ঢেউ থেমে গেল! স্রোত যদি তার তরঙ্গ হারায়, তবে তার ব্যথা সে নিজেই বোঝে, বাঁধ-দেওয়া প্রশান্ত দিঘির জল তার সে বেদন বুঝবে না। মুক্তকে যখন বন্ধনে আনবার চেষ্টা করা হয়, তখনই তার তরঙ্গের কল্লোলে মধুর চল-চপলতার কলহ-বাণী ফুটে ওঠে! তাই এ-রকমে চলার পথে বাধা পেয়েই আমাদের সহজ ঢেউ বিদ্রোহী হয়ে মাথা তুলে সামনের সকল বাধাকে ডিঙিয়ে যেতে চাইলে। চির-চঞ্চলের প্রাণের ধারা এই চপল গতিকে থামাবে কে? পথের সাথি আমার হঠাৎ তার চলায় বাধা পেয়ে বক্র-কুটিল গতি নিয়ে তার সাথিকে খুঁজতে ছুটল। এতদিনে যেন সে তার প্রাণের ঢেউ-এর খবর পেলে!

সর্বক্ষণ কাছে পেয়ে যাকে সে পেতে চেষ্টা করেনি, সে দূরে সরে এই দূরত্বের ব্যথা, ছাড়াছাড়ির বেদনা তার বুকে প্রথম জেগে উঠতেই সে তাকে চিনল এবং বলে উঠল, – ‘যাকে চাই তাকে পেতেই হবে।’

বঞ্চিত স্নেহের হাহাকার, ছিন্ন বাসনার আকুল কামনা তার বুকে উদ্দাম উন্মাদনা জাগিয়ে দিয়ে গেল! তখন সে তার এই আকাঙ্ক্ষিত আশ্রয়কে নতুন পথে নতুন করে খুঁজতে লাগল। সে অন্তরে বুঝলে, এ সাথি না হলে আমি আমার গতি হারাব! এই রকম মুক্তি আর বন্ধনের যুঝাযুঝির মাঝে পড়ে সে কাহিল হয়ে উঠল! সমাজ বললে, – রাখ তোর এ মুক্তি – আমি এই দেওয়াল দিলাম!

সেই দেওয়ালে মাথা খুঁড়ে রক্ত-গঙ্গা বহালে, পাষাণের দেওয়াল – ভাঙতে পারলে না!

এ-দিকে আমাকে কেউ রাখতে পারলে না! লোকের চলার উলটো পথে উজান বেয়ে চলাই হল আমার কাজ! অনেক মারামারি করেও যখন আমাকে স্কুলের খাঁচায় পুরতে পারলে না, তখন সবাই বললে, – এ ছেলের যদি লেখাপড়া হয় তবে সুগ্রীব-সহচর দগ্ধমুখ হনুবংশ কী দোষ করেছিল? তারাও হাল ছেড়ে দিলে, আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেখলাম এই বাধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে যত তাকে ভুলে রয়েছি, ততই যেন সে আমার একান্ত আপনার হয়ে আমার নিকটতম কাছে এসে আমার উপর তার সব নির্ভরতা সঁপে গেছে! –

যমুনা আসছিল সাগরের পানে, ওই সাগরও তার দিগন্ত-ছোঁয়া ঢেউ-এর আকুলতা লক্ষ বাহুর ব্যগ্রতা নিয়ে তার দিকে ছুটে যেতে চাইল! দুজনেই অধীর হয়ে পড়েছিল এই ভেবে – হায়! কবে কোন্ মোহানায় তাদের চুমোচুমি হবে, তারা এক হয়ে যাবে!…

আর আমাদের দেখা-শোনা হত না। কথা যা হত, তা কখনও সবাইকে লুকিয়ে ওই একটি চোরা-চাওয়ায়, নয়তো বাতায়নের ফাঁক দিয়ে দুটি তৃষিত অতৃপ্ত দৃষ্টির বিনিময়ে। ওই এক পলকের চাওয়াতেই যে আমাদের কত কথা শুধানো হয়ে যেত, কত ব্যথা-পুলক শিউরে উঠত, তা ঠিক বোঝানো যায় না!

* * *
আরও পাঁচ বছর পরের কথা! –

একদিন শুনলাম তার বিয়ে হবে, মস্ত বড়ো জমিদারের ছেলে বি-এ পাস এক যুবকের সাথে। বিয়ে হবার পর সে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তার সাথে আমার এই চোখের চাওয়াটুকুও ফুরাবে, এই ব্যথাটুকুই বড়ো গভীর হয়ে মর্মে আমার দাগ কেটে বসে গেল! এ ব্যথার প্রগাঢ় বেদনা আমার বুকের ভিতর যেন পিষে পিষে দিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু যখন মেঘ-ছাড়া দীপ্ত মধ্যাহ্ন-সূর্যের মতো সহসা এই কথাটি আমার মনে উদয় হল যে, সে সুখী হবে, তখন যেন আমি আমার নতুন পথ দেখতে পেলাম। বললাম, – না, আমি জন্মে কারুর কাছে মাথা নত করিনি, আজও আমাকে জয়ী হতে হবে। আর দুঃখই বা কীসের? সে ধনী শিক্ষিত সুন্দর যুবকের অঙ্কলক্ষ্মী হবে, অভাগি মেয়েদের সুখী হবার জন্যে যা-কিছু চাওয়া যায় তার সব পাবে; কিন্তু হায়, তবু অবুঝ মন মানে না! মনে হয়, আমার মতোন এত ভালোবাসা তো সে পাবে না!

এই কথা ক-টি ভাবতে গিয়ে আমার বুক কান্নায় ভরে এল, – আমার যে বাইরের দীনতা তাই মনে পড়ে তখন আমাকে আমার অন্তরের সত্য-প্রেমের গৌরবের জোরে খাড়া হতে হল। এক অজানার উপর তীব্র অভিমানের আক্রোশে বললাম, নিজের সুখ বিলিয়ে দিয়ে এর প্রতিহিংসা নেব। ত্যাগ দিয়ে আমার দীনতাকে ভরে তুলব।

এত দ্বন্দ্বের মাঝে’ আমার প্রিয় সুখী হবে’ এই কথাটির গভীর তত্ত্ব প্রাণে আমার ক্রমেই কেটে কেটে বসতে লাগল, তার পর হঠাৎ এক সময় আমার বুকের সব ঝঞ্ঝা ঝড় বেদনা তরঙ্গ ধীর শান্ত স্তব্ধ হয়ে গেল! বিপুল পবিত্র সান্ত্বনায় তিক্ত মন আমার যেন সুধাসিক্ত হয়ে গেল! আঃ! কোথায় ছিলে এতদিন ওগো বেদনার আরাম আমার? এতদিন পরে নিশ্চিন্ততার কান্না কেঁদে শান্ত হলাম!

এ কোন্ অর্ফিয়াসের বাঁশির মায়া-তান, এমন করে আমার মনের দুরন্ত সিন্ধুকে ঘুম পাড়িয়ে গেল? … হায়, এতদিন বাঁশির এই জাদু-করা সুর কোথায় ছিল? –

সে দিন নিশীথ রাতে তার বাতায়নের পানে চেয়ে তাই গেয়েছিলাম, –

‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে!
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
জীবন ভরে?’

বাঃ, এরই মধ্যেই দেখচি মাঠের সারা পথটা পেরিয়ে গাঁয়ের সীমা-রেখার কাছাকাছি এসে পড়েছি! দূর হতে ঘরে ঘরে মাটির আর কেরোসিনের যে ধোঁয়া-ভরা দীপের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতেই আমার মন কেমন ওই প্রদীপ-জ্বালা ঘরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে! মনে হচ্ছে, ওই দীপের পাশে ঘোমটা-পরা একটি ছোটো মুখ হয়তো তার দু-চোখ-ভরা আকুল প্রতীক্ষা নিয়ে পথের পানে চেয়ে আছে। দখিন হাওয়ায় গাছের একটি পাতা ঝরে পড়লে অমনি সে চমকে উঠছে, – ওই গো বুঝি তার প্রতীক্ষার ধন এল! তার বুকে এই রকম আশা-নিরাশার যে একটা নিবিড় আনন্দ ঘুরপাক খাচ্ছে, তারই নেশায় সে মাতাল!

আমার মনের সেই চিরকেলে অক্লান্ত বিরহী শ্রোতা তাড়া দিয়ে কয়ে উঠল, – ও সব পরে ভেবোখন, তার পর কী হল, বলো!…

তখন গাঁয়ের মাথায় মায়ের নত-আঁখির স্নেহ-চাওয়ার মতো নিবিড় শান্তি নেমে এসেছে। করুণ বেদনার সাথে পবিত্র স্নিগ্ধতা মিশে আমার নয়ন-পল্লব সিক্ত করে আনলে।

জল-ভরা চোখে আমার বাকি কথাটুকু মনে পড়ল।…

তার বিয়ের দিন কতক আগের এক রাতে তাতে আমাতে প্রথম ও শেষ গোপন দেখা শোনা। সে বললে – ‘এ বিয়েতে কী হবে ভাই?’

আমি বললাম, ‘তুমি সুখী হবে।’

সে আমার সহজ কণ্ঠ শুনে তার বয়সের কথা, আমার বয়সের কথা – আমাদের ব্যবধানের কথা সব যেন ভুলে গেল। মাথার উপর আকাশ ভরা তারা মুখ টিপে হেসে উঠল। সে আবার তেমনই করে সেই ছেলেবেলার মতো আমার হাতের আঙুলগুলো ফুটিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তা কী করে হবে? তোমাকে যে ছেড়ে যেতে হবে, তোমাকে যে আর দেখতে পাব না।’

এত দিনে তার এই নতুন রকমের আর্দ্র কণ্ঠের বাণী শুনলাম! তার টানা টানা চোখের ঘন দীর্ঘ পাতায় তারার ক্ষীণ আলো প্রতিফলিত হয়ে জানিয়ে দিল, সে কাঁদছে!

আমি বললাম, – ‘তোমার কথা বুঝতে পেরেছি মোতি। কিন্তু তুমি যার কাছে যাবে, সে আমার চেয়েও তোমায় বেশি ভালোবাসবে; সেখানে গেলে আমাদের সব কথা ভুলে যাবে।’

অন্যে আমার প্রিয়কে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে, এই চিন্তাটাও যেন অসহ্য। তার স্বামী আমার চেয়ে ধনী হোক, সুন্দর হোক, শিক্ষিত হোক, কিন্তু আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসবে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে, বড়ো অভিমানেই ওই কথাটা আমি বললাম, কিন্তু এ-কথাটা বলেই এবার আমারও যেন বিপুল কান্না কণ্ঠে ফেটে বেরিয়ে আসতে লাগল। সে কান্না রুধবার শক্তি নেই – শক্তি নেই। মূর্ছাতুরার মতো সে আমার হাতটা নিয়ে জোরে তার চোখের উপর চেপে ধরে আর্ত কণ্ঠে কয়ে উঠল, ‘না–না– না।’ কীসের এ ‘না’?

আমি তীব্র কণ্ঠে কয়ে উঠলাম, – ‘ এ হতেই হবে মোতি, এ হতেই হবে। আমায় ছাড়তেই হবে।’

তখন এক অজানা দেবতার বিরুদ্ধে আমার মন অভিমানে আর তিক্ততায় ভরে উঠেছে। সে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে কয়ে উঠল, – ‘ওগো, চিরদিন তো আমায় মেরে এসেছ, এখনও কি তোমার মেরে সাধ মেটেনি? তবে মারো, আরও মারো – যত সাধ মারো।’

কত দিনের কত কথা কত ব্যথা আমার বুকের মাঝে ভরে উঠল! তার পরেই তীব্র তীক্ষ্ণ একটা অভিমানের কঠোরতা আমায় ক্রমেই শক্ত করে তুলতে লাগল। মন বললে – জয়ী হতেই হবে।

আমি ক্রূর হাসি হেসে মোতিকে বললাম, ‘হুঁ! কিছুতেই মানবে না তো, তবে সত্যি কথাটাই বলি, – মোতি, তোমায় যে আমি ভালোবাসি না।’

কথাটা তার চেয়ে আমার বুকেই বেশি বাজল। সে তীরবিদ্ধা হরিণীর মতো চমকে উঠে বললে, – ‘কী?’

আমি বললাম, – ‘তোমায় এতদিন শুধু মিথ্যা দিয়ে প্রতারিত করে এসেছি মোতি, কোনোদিন সত্যিকার ভালোবাসিনি।’

আমার কণ্ঠ যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আহত ফণিনীর মতো প্রদীপ্ত তেজে দাঁড়িয়ে সে গর্জন করে উঠল, – ‘যাও চলে যাও – তোমায় আমি চাইনে, সরে যাও। তুমি জল্লাদের চেয়েও নিষ্ঠুর, বে-দিল ! – যাও, সরে যাও।… তোমার পায়ে পড়ি চলে যাও, আর আমার ভালোবাসার অপমান কোরো না।’

দু-চোখ হাত দিয়ে টিপে কালবৈশাখীর উড়ো ঝঞ্ঝার মতো উন্মাদ বেগে সে ছুটে গেল। আমি টাল খেয়ে মাথা ঘুরে পড়তে পড়তে শুনতে পেলাম আর্ত-গভীর আর্তনাদের সঙ্গে বিয়ে-বাড়ির ছালনা-বাঁধা আঙিনায় কে দড়াম করে আছড়ে পড়ে গোঙিয়ে উঠল, – ‘মা–গো।’

ওই যে অনেক দূরের খেয়া-পারে ক্লান্ত মাঝির মুখে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত মনের চিরন্তন কান্নাটি ফুটে উঠেছে, ও যেন আমারই মনের কথা, –

মন-মাঝি তোর বইঠা নে রে,
আমি আর বাইতে পারলাম না।’
ওগো আমার মনের মাঝি, আমারও এ-ক্লান্তি-ভরা জীবন-তরি আর যে বাইতে পারি নে ভাই! এখন আমায় কূল দাও, না হয় কোল দাও! –

অতৃপ্ত কামনা-কাজী নজরুল ইসলামআমার মনে বড়ো ব্যথা রয়ে গেল, সে হয়তো আমার ব্যথা বুঝলে না। যাকে ভালোবাসি, তাকে ব্যথা দিতে গিয়ে আমার নিজের বুক যে ব্যথার আঘাতে, বেদনার কাঁটায় কত ছিন্ন-ভিন্ন কীরকম ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, হায়, তা যদি সে জানত – তা যদি মোতি বুঝতে পারত। ওঃ যাকে ভালোবাসি সেও যদি আমাকে ভুল বোঝে, তবে আমি বাঁচি কী নিয়ে? আমার এ রিক্ত জীবনের সার্থকতা কী? হায়, দুনিয়ায় এর মতো বড়ো বেদনা বুঝি আর নেই।

এই তো আমার গাঁয়ের আমবাগানে এসে ঢুকেছি। ওই তো আমার বন্ধ-করা আঁধার ঘর। চার পাশে দীপ-জ্বালানো কোলাহল-মুখরিত স্নেহনিকেতন, আর তারই মাঝে আমার বিজন আঁধার কুটির যেন একটা বিষমাখা অভিশাপ শেলের মতো জেগে রয়েছে। দিনের কাজ শেষ করে বিনা-কাজের সেবা হতে ফিরে ঘরে ঢুকবার সময় রোজ যে-কথাটি মনে হয়, বন্ধ দুয়ারের তালা খুলতে খুলতে আজও সেই কথাটিই আমার মনের চির ব্যথার বনে দাবানল জ্বালিয়ে যাচ্ছে।

একে একে সব ঘরেই প্রদীপ জ্বলবে, শুধু আমার একা ঘরেই আর কোনো দিন সন্ধ্যা-দীপ জ্বলবে না। সেই ম্লান দীপ-শিখাটির পাশে আমার আসার আশায় কোনো কালোচোখের করুণ-কামনা ব্যাকুল হয়ে জাগবে না!

বাইরে আমার ভাঙা দরজায় উতল হাওয়ার শুধু একরোখা বুকচাপড়ানি আর কারবালা-মাতম রণিয়ে উঠল, –

‘হায় গৃহহীন, হায় পথবাসী, হায় গতি-হারা!’
আমার হিয়ার চিতার চিরন্তনী ক্রন্দসীও সাথে সাথে কেঁদে উঠল, –

‘হায় গৃহহীন, হায় পথবাসী, হায় গতি-হারা!’